ঈশ, কেন ও কঠোপনিষদ - পণ্ডিত রাজবীর শাস্ত্রী
ঈশ, কেন ও কঠোপনিষদের সমীক্ষাসহ ভাষ্য
ভাষ্যকারঃ পণ্ডিত রাজবীর শাস্ত্রী
ভূমিকাঃ মানুষ চিরকাল পরম শান্তি ও স্থায়ী সুখের সন্ধান করেছে, কিন্তু ভোগ-বিলাস কখনোই তাকে তৃপ্ত করতে পারেনি। প্রাচীন ঋষি-মুনিরা উপলব্ধি করেছিলেন যে প্রকৃত সুখের উৎস কেবল ব্রহ্মজ্ঞানেই নিহিত, আর সেই জ্ঞানই উপনিষদে সংকলিত হয়েছে। 'উপনিষদ' শব্দের অর্থ— পরব্রহ্মের সান্নিধ্যে পৌঁছানোর বিদ্যা, যা সংসারের দুঃখ-দুর্দশা নাশ করে মুক্তির পথ দেখায়। এই গভীর আত্মজ্ঞান কেবল যোগ্য শিষ্য ও ঈশ্বরকৃপায় লাভযোগ্য, তাই একে 'রহস্যবিদ্যা'ও বলা হয়।
উপনিষদের আধ্যাত্মিক শিক্ষা শুধু ভারতীয় সমাজেই নয়, বিদেশী পণ্ডিত ও সাধকদেরও আকর্ষণ করেছে। শোপেনহার, ম্যাক্স মুলার, দারাশিকোহ প্রমুখ যেমন এর মহিমা স্বীকার করেছেন, তেমনি স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগরও একে মানবজাতির মুক্তির পথ বলেছেন। প্রকৃতপক্ষে, উপনিষদ শুধু দর্শন নয়, মানবজাতির শক্তি, স্বাধীনতা ও আধ্যাত্মিক উন্নতির অফুরন্ত ভাণ্ডার।
person ভাষ্যকার পরিচিতি
বৈদিক শাস্ত্রের প্রখর পণ্ডিত পণ্ডিত রাজবীর শাস্ত্রীর জন্ম ১৯৩৮ সালের ৪ঠা এপ্রিল, উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদ জেলার ফজলগড় গ্রামে। তাঁর পিতার নাম ছিল শ্রী শিবচরণ দাস। তিনি গুরুকুল ঝজ্জরে (হরিয়ানা) শিক্ষালাভ করেন। তিনি মেরাট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংস্কৃতে এম.এ. এবং বারাণসী থেকে আচার্য (প্রাচীন ব্যাকরণ) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি দিল্লি প্রশাসনের অধীনে সংস্কৃত অধ্যাপনা করেন। আর্যসাহিত্য প্রচার ট্রাস্ট, দিল্লির গ্রন্থ রচনা, সম্পাদনা ও সংশোধনের কাজে তাঁর অবদান রয়েছে, যার ফলে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বহু বছর ধরে 'দয়ানন্দ সন্দেশ' মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করে আসছেন।
auto_stories বই পরিচিতি
উপনিষদের গুরুত্ব:
মানুষ পৃথিবীর দুঃখ-কষ্টে ক্লান্ত হয়ে সৃষ্টির আদিকাল থেকেই পরম শান্তি ও চিরন্তন সুখের সন্ধান করে আসছে। সাংসারিক ভোগের সুখ ক্ষণস্থায়ী ও নশ্বর; এগুলিতে চিরন্তন সুখের আশা করা মরীচিকার মরুভূমিতে জলের সন্ধানের মতোই। মানুষ সাংসারিক ভোগে মত্ত হয়ে সমস্ত জীবন কাটিয়ে দেয়, কিন্তু পরম সুখ লাভ করে না। মহারাজ ভর্তৃহরি যথার্থই বলেছেন— "ভোগা ন ভুক্তা বয়মেব ভুক্তাঃ।" (ভর্তৃহরি) অর্থাৎ, ভোগগুলি ভোগ করা যায় না, বরং ভোগই আমাদের গ্রাস করে। অর্থাৎ জীবন শেষ হয়ে যায়, কিন্তু ভোগ-বাসনার তৃপ্তি হয় না। মনুঋষির ভাষায়— "ন জাতু কামঃ কামানামুপভোগেন শাম্যতি। হবিষা কৃষ্ণবর্ত্মেব ভূয় এবাভিবর্ধতে॥" (মনু) অর্থাৎ, কখনও কামনা-বাসনার দ্বারা শান্তি হয় না, বরং তা আরও বাড়ে, যেমন ঘি দ্বারা অগ্নি প্রজ্বলিত হয়। ধন-সম্পদে পরিপূর্ণ দেশগুলি এর জ্বলন্ত প্রমাণ— সেখানে সাংসারিক সুখের অভাব নেই, কিন্তু প্রকৃত সুখ ও শান্তি কোথায়? উপনিষদকার ঠিকই বলেছেন— "ন বিত্তেন তর্পণীয়ো মনুষ্যঃ।" (কঠোপনিষদ ২.২৭) অর্থাৎ, মানুষ সাংসারিক ধন-সম্পদ বা বস্তু দ্বারা কখনও তৃপ্ত হতে পারে না। সমস্ত বৈদিক দর্শনের লক্ষ্যই হল— চিরন্তন সুখ (মোক্ষ) কীভাবে লাভ করা যায়। বিশ্বের প্রাচীনতম গ্রন্থ, ঈশ্বরপ্রদত্ত জ্ঞান বেদে বলা হয়েছে— শুদ্ধ অন্তঃকরণ নিয়ে ধর্মাচরণের মাধ্যমে পরব্রহ্মকে জানাই মোক্ষলাভের উপায়। বেদে উল্লেখ আছে— "তমেব বিদিত্বাতিমৃত্যুমেতি নান্যঃ পন্থা বিদ্যতেঽয়নায়।" (যজুর্বেদ ৩১.১৮) "যস্য ছায়ামৃতং যস্য মৃত্যুঃ।" (যজুর্বেদ ২৫.১৩) অর্থাৎ, পরব্রহ্মকে জানলেই মৃত্যু=দুঃখ অতিক্রম করে মোক্ষলাভ করা যায়, এর অন্য কোনো পথ নেই। কারণ, সেই পরমব্রহ্মের আশ্রয়ই মোক্ষসুখপ্রদ, আর তাঁর কৃপা না পাওয়া বা উপাসনা না করাই মৃত্যু=দুঃখের কারণ। সেই পরব্রহ্মকে জানার ও পাবার জন্য ঋষি-মুনিরা তপস্যা করে যে জ্ঞান (ব্রহ্মজ্ঞান) লাভ করেছেন, তারই সংকলন উপনিষদ গ্রন্থে রয়েছে। তাই এগুলিকে ব্রহ্মজ্ঞানের সর্বোৎকৃষ্ট গ্রন্থও বলা হয়।
'উপনিষদ' শব্দের অর্থ:
'উপনিষদ' শব্দে 'উপ' ও 'নি' দুটি উপসর্গ এবং 'ষদ্লৃ' ধাতু রয়েছে। এর অর্থ হল— "উপ সমীপেন নিতরাং সীদন্তি প্রাপ্নুবন্তি পরং ব্রহ্ম যয়া বিদ্যয়া সা উপনিষদ্।" অর্থাৎ, উপনিষদ হল সেই বিদ্যা, যা দ্বারা পরব্রহ্মের জ্ঞান লাভ করে তাঁর সান্নিধ্য পাওয়া যায়। আর যেহেতু উপনিষদ্ পরব্রহ্ম-জ্ঞানের আলোচনা করে, তাই 'ঈশ' প্রভৃতি গ্রন্থগুলিও উপনিষদ নামে পরিচিত।
শঙ্করাচার্য উপনিষদের ব্যাখ্যায় লিখেছেন— "সেয়ং ব্রহ্মবিদ্যা উপনিষদ্ বাচ্যা সংসারস্যাত্যন্তাবসাদনাৎ উপপূর্বস্য সদেস্তদর্থত্বাৎ গ্রন্থোহপ্যুপনিষদ্ উচ্যতে।" (বৃহদারণ্যক ভূমিকা) অর্থাৎ, এই ব্রহ্মবিদ্যা (উপনিষদ্) সংসারের সমস্ত দুঃখ দূর করে। তবে এটা ঠিক নয় যে উপনিষদ্ সংসারকে উচ্ছেদ করে, বরং এটি দুঃখের উচ্ছেদ করে। এই বিদ্যা অত্যন্ত গূঢ় হওয়ায় 'রহস্য' নামেও পরিচিত। ব্যাকরণ মহাভাষ্যে পতঞ্জলি লিখেছেন— "চত্বারো বেদাঃ সাঙ্গাঃ সরহস্যা বহুধা ভিন্নাঃ।" (মহাভাষ্য, পস্পশাহ্নিক) পাণিনিও তাঁর সূত্রে (১.৪.৬৯) 'উপনিষদ্' শব্দের অর্থ 'গোপন' বলেছেন— "উপনিষৎকৃত্য গতঃ।" অর্থাৎ, কোনো বিষয়কে গোপন বা রহস্যময় বলা। এ থেকেও উপনিষদের রহস্যময় স্বরূপ ফুটে ওঠে।
উপনিষদের গূঢ় জ্ঞান:
কঠোপনিষদে নচিকেতার তৃতীয় বর হিসেবে আত্মবিদ্যা চাওয়ার পর যমরাজ তাকে নানা প্রলোভন দেন, কিন্তু শেষে তাঁকে যোগ্য জ্ঞানার্থী জেনে আত্মবিদ্যা দান করেন এবং বলেন— "আশ্চর্যোঽস্য বক্তা কুশলোঽস্য লব্ধাশ্চর্যো জ্ঞাতা কুশলানুশিষ্টঃ॥" (কঠোপনিষদ ১.২.৭) অর্থাৎ, এই বিদ্যার বক্তা ও শ্রোতা দুর্লভ। কেবল আত্মতত্ত্বের সাক্ষাৎকারপ্রাপ্ত ব্যক্তিই এ বিষয়ে উপদেশ দিতে পারেন। সাধারণ মানুষের এতে প্রবেশাধিকার নেই। আর "নায়মাত্মা প্রবচনেন লভ্যঃ"— অর্থাৎ, আত্মজ্ঞান কেবল ঈশ্বরের কৃপায়ই লাভ হয়।
ভারতীয় ঋষি-মুনিরা এই রহস্যময় বিদ্যা সম্পূর্ণরূপে আয়ত্ত করে বিশ্বকে প্রথম এর শিক্ষা দিয়েছিলেন। তাই আজও দার্শনিকেরা ভারতকে আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে বিশ্বগুরু বলে মানেন। এই উপনিষদ-বিদ্যা কেবল বৈদিক ধর্মাবলম্বীদেরই নয়, বহু বিদেশী ও ভিন্নধর্মীদেরও মুগ্ধ করেছে। ইসলাম ধর্মাবলম্বী দারাশিকোহ, মনসুর, সরমদ, ফৈজি ও বুল্লাশাহ উপনিষদের ভক্ত ছিলেন। দারাশিকোহ কেবল উপনিষদের সিদ্ধান্তই মানেননি, ফারসি ভাষায় এর অনুবাদও করেছিলেন এবং এগুলিকে জীবনের সারবস্তু করে তুলেছিলেন। মনসুর ও সরমদ উপনিষদের সত্যের জন্য প্রাণও দিয়েছেন। পাশ্চাত্য পণ্ডিত ম্যাক্সমুলার, শোপেনহার, গোল্ডস্টকার প্রমুখ উপনিষদের অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন।
বিদেশী পণ্ডিতদের মন্তব্য:
১. ম্যাক্স মুলার: "উপনিষদ্ হল বেদান্তদর্শনের মূল উৎস, এবং এগুলি এমন রচনা যেখানে মানবীয় চিন্তা তার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেছে বলে বোধ হয়।"
২. শোপেনহার: "সমগ্র বিশ্বে উপনিষদের মতো এমন কোনো অধ্যয়ন নেই, যা এত উপকারী ও উন্নতির পথ দেখায়। এগুলি উচ্চতম বুদ্ধির ফল। উপনিষদ্ আমার জীবনসরোবরে অমৃতসিঞ্চন করেছে। একদিন এটিই মানুষের ধর্ম হবে।"
৩. ড. গোল্ডস্টকার: "বেদান্ত হল সর্বোচ্চ স্তরের দর্শন, যা প্রাচ্য চিন্তাধারা উৎপাদন করেছে।"
৪. মিস্টার হোম: "সক্রেটিস, অ্যারিস্টটল, প্লেটোর মতো শতাধিক মহাপণ্ডিত বিশ্বে জন্মেছেন, কিন্তু যাঁরা উপনিষদ রচনা করেছেন, তাঁদের চেয়ে বড় পণ্ডিত কেউ হননি, হবেও না।"
৫. পাদ্রি মার্ডক: "উপনিষদের জ্ঞান প্রতিটি নিরাশাবাদীর হৃদয়ের জন্য শান্তিদায়ক। এগুলি পরমাত্মার সন্ধানে পথ দেখায়, যেমন প্রভাতের বাগানে ঘুরে মন প্রফুল্ল হয়। বাইবেলে ঈশ্বর মানুষের সন্ধান করেন, কিন্তু উপনিষদে মানুষ ঈশ্বরের সন্ধান করে।"
৬. স্যার উইলিয়াম হান্টার: "রোমান, গ্রিকরা যে সমস্যার সমাধান করতে পারেনি, মধ্যযুগ ও আধুনিক বিজ্ঞানীদের যে প্রশ্নগুলি বিব্রত করেছে, তার সব উত্তর উপনিষদে রয়েছে।"
৭. অ্যাংকেটিল ডুপেরঁ: "উপনিষদ্ যোগ ও ব্রহ্মবিদ্যার ভাণ্ডার। এগুলি অধ্যয়ন করলে হৃদয় শান্ত হয়, চিন্তাশক্তি বাড়ে, মানসিক অস্থিরতা কমে ও মনে আনন্দ আসে।"
৮. রেভারেন্ড এ. গেডন: "উপনিষদ্ হল মানবজাতির জন্য ধর্মীয় প্রেরণা ও আত্মিক জীবনের পবিত্রতম সম্পদ।"
ভারতীয় পণ্ডিতদের দৃষ্টিভঙ্গি:
১. রাজা রামমোহন রায়: "উপনিষদেই পরমাত্মার সম্পূর্ণ জ্ঞান বর্ণিত আছে, যা বেদ ও বেদান্তের বিশেষ অংশ।"
২. ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর: "উপনিষদ্ ঈশ্বরের একত্ব ও আধ্যাত্মবিদ্যার উপদেশ দেয়, যা সমস্ত বিজ্ঞানেরও মূল।"
৩. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: "চক্ষুষ্মানরা দেখবেন, ভারতের ব্রহ্মজ্ঞান সমগ্র পৃথিবীর ধর্ম হয়ে উঠছে।"
৪. স্বামী বিবেকানন্দ: "উপনিষদের প্রতিটি পাতা শক্তির বার্তা দেয়। এগুলি বলে— 'হে মানুষ, তেজস্বী হও, বলবান হও, দুর্বলতাকে ত্যাগ কর।' উপনিষদ্ শক্তির অফুরন্ত ভাণ্ডার। মুক্তি— দৈহিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক স্বাধীনতা— এটিই উপনিষদের মূল মন্ত্র।"
উপনিষদের গুরুত্ব সর্বজনবিদিত। ব্রহ্মবিদ্যার অমৃত যে একবার আস্বাদন করে, সে আর কখনও তা ছাড়তে পারে না। এই জ্ঞানীরা যে আনন্দ লাভ করেন, তা বর্ণনার অতীত। উপনিষদকার নিজেই বলেছেন— "ন শক্যতে বর্ণয়িতুং গিরা তদা স্বয়ং তদন্তঃকরণেন গৃহ্যতে।" অর্থাৎ, এ জ্ঞান বাক্যে বর্ণনীয় নয়, একে হৃদয় দিয়েই উপলব্ধি করতে হয়।
info বইয়ের বিস্তারিত তথ্য
downloadডাউনলোড করুন
আপনার পছন্দের ফরম্যাটে বইটি ডাউনলোড করতে নিচের বাটনে ক্লিক করুন:
(ডাউনলোড লিঙ্ক কাজ না করলে বা কোনো সমস্যা হলে অনুগ্রহ করে মন্তব্য করুন।)
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন